সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

দয়া দেখানোর অভ্যাস গড়ে তুলুন

দয়া দেখানোর অভ্যাস গড়ে তুলুন

লিসা * ও অ্যান নামে দু-জন বোন যখন যিহোবার সাক্ষিদের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করতে শুরু করেছিলেন, তখন তাদের খুবই ভালো লেগেছিল। আজও তারা বাইবেল পড়তে এবং ধ্যান করতে খুবই ভালোবাসেন। কিন্তু, এগুলো করতে ভালোবাসেন বলেই যে তারা সত্যে এসেছেন, এমন নয়। লিসা বলেন, “আমি যখন ভাই-বোনদের ভালোবাসা ও যত্ন দেখেছিলাম, তখন আমার যে কতটা ভালো লেগেছিল, তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।” অ্যানের অভিজ্ঞতাও কিছুটা একইরকম। তিনি বলেন, “বাইবেলের শিক্ষার চেয়েও ভাই-বোনদের ভালোবাসা ও যত্ন আমার হৃদয়কে বেশি স্পর্শ করেছিল।” এই বোনদের কথা থেকে বোঝা যায় যে, ভালোবাসা ও দয়ার মতো গুণের দ্বারা তারা ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।

কীভাবে আমরা অন্যদের প্রতি দয়া দেখানোর দ্বারা তাদের হৃদয় স্পর্শ করতে পারি? দুটো উপায়ে: আমাদের কথার মাধ্যমে এবং আমাদের কাজের মাধ্যমে। এর সঙ্গে সঙ্গে আমরা এও জানব যে, আমাদের কাদের প্রতি দয়া দেখাতে হবে।

কথার মাধ্যমে

হিতোপদেশ ৩১ অধ্যায় এমন একজন স্ত্রীর বিষয়ে বলে, যার মুখে “দয়ার ব্যবস্থা” রয়েছে। (হিতো. ৩১:২৬) এর মানে হল তিনি যখনই কিছু বলেন আর সেটা যেভাবে বলেন, তাতেই তিনি ‘দয়া’ দেখিয়ে থাকেন। একইভাবে, বাবা-মায়েরাও কথা বলার সময় ‘দয়া’ দেখিয়ে থাকেন। অনেক বাবা-মায়েরা জানেন যে, তারা যদি তাদের বাচ্চাদের সঙ্গে কঠোরভাবে কথা বলেন, তাহলে তারা কখনোই তাদের বাবা-মায়ের কথা শুনতে চাইবে না। কিন্তু, তার বদলে বাবা-মায়েরা যদি তাদের সন্তানদের সঙ্গে সদয়ভাবে কথা বলেন, তাহলে তারা তাদের কথায় অবশ্যই বাধ্য হবে।

আমাদের সন্তান থাকুক অথবা না-ই থাকুক, কীভাবে আমরা সদয়ভাবে কথা বলতে পারি? এর উওরটা হিতোপদেশ ৩১:২৬ পদের প্রথম অংশে পাওয়া যায়। সেখানে বলা রয়েছে, “তিনি প্রজ্ঞার সহিত মুখ খোলেন।” এর মানে হল আমাদের কথা বলার আগে চিন্তা করতে হবে যে, আমরা কী বলব এবং কীভাবে বলব। আমরা নিজেদের জিজ্ঞেস করতে পারি, ‘আমি যা বলতে যাচ্ছি, সেই কথার দ্বারা পরিস্থিতি কি খারাপ হয়ে উঠবে না কি আমার কথার দ্বারা পরিস্থিতি শান্ত হবে?’ (হিতো. ১৫:১) এভাবে আমরা যদি নিজেদের জিজ্ঞেস করি আর তারপর কথা বলি, তাহলে আমরা ভেবে-চিন্তে কথা বলতে পারব।

হিতোপদেশ বইয়ের আরেকটা পদ বলে, “কেহ কেহ অবিবেচনার কথা বলে, খড্‌গাঘাতের মত।” (হিতো. ১২:১৮) কিছু বলার আগে আমাদের চিন্তা করতে হবে যে, আমরা যা বলি আর যেভাবে বলি, তা অন্যদের ওপর কেমন প্রভাব ফেলবে। এভাবে আমরা আমাদের কথাবার্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। সত্যিই, আমরা যদি “দয়ার ব্যবস্থা” মেনে চলি অর্থাৎ সদয়ভাবে কথা বলি, তাহলে আমরা কখনো কাউকে আঘাত দিয়ে বা কারো সাথে নির্দয়ভাবে কথা বলব না। (ইফি. ৪:৩১, ৩২) এর পরিবর্তে, আমরা অন্যদের সঙ্গে কথা বলার সময় ভালোবাসা ও নম্রতা দেখাব এবং এমনভাবে কথা বলব যাতে লোকদের হৃদয় স্পর্শ করে। এই ক্ষেত্রে যিহোবা এক চমৎকার উদাহরণ রেখেছেন। একবার যখন তাঁর দাস এলিয় খুব উদ্‌বিগ্ন ছিলেন, তখন যিহোবা একজন স্বর্গদূতের মাধ্যমে তাকে সাহস জুগিয়েছিলেন। বাইবেল বলে, সেই সময়ে যিহোবা এলিয়ের সঙ্গে ‘কোমল ও মৃদু কণ্ঠস্বরে’ কথা বলেছিলেন। (১ রাজা. ১৯:১২) কিন্তু, ভালো কথা বলার সঙ্গে ভালো কাজ করাও জরুরি। আসুন, আমরা এই বিষয়ে আরও দেখি।

কাজের মাধ্যমে

যিহোবার মতো হয়ে ওঠার জন্য আমাদের সদয়ভাবে কথা বলার পাশাপাশি আমাদের আচার-ব্যবহারেও দয়া দেখাতে হবে। (ইফি. ৪:৩২; ৫:১, ২) এই প্রবন্ধের শুরুতে বলা লিসা বলেন যে, তার সঙ্গে এবং তার পরিবারের সঙ্গে যিহোবার সাক্ষিরা কেমন আচরণ করেছিলেন। তিনি বলেন, “আমরা বাড়ি পরিবর্তন করছিলাম আর আমাদের হাতে বেশি সময় ছিল না। তাই, দুই দম্পতি তাদের কাজের জায়গায় ছুটি নিয়ে আমাদের সাহায্য করতে আসেন আর তারা যিহোবার সাক্ষি ছিলেন। সেই সময় আমি বাইবেল অধ্যয়নও করছিলাম না!” সেই দম্পতিদের সদয় কাজ লিসার ওপর এতটাই প্রভাব ফেলেছিল যে, তিনি বাইবেল অধ্যয়ন করতে শুরু করেন।

এই প্রবন্ধের শুরুতে বলা অ্যানও সাক্ষিদের ভালো ব্যবহারের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি বলেন, “যেহেতু লোকেরা আমাকে বার বার ঠকিয়েছিল, তাই যেকোনো ব্যক্তির উপর আমি ভরসা করতে পারতাম না। আর সেই কারণেই যিহোবার সাক্ষিদের সঙ্গে আমার যখন পরিচয় হয়, তখনও আমি তাদের উপর সঙ্গেসঙ্গে ভরসা করতে পারিনি। আমি ভাবতে শুরু করি, ‘কেন তারা আমার বিষয়ে এত বেশি চিন্তা করে?’ তারপর আমি বুঝতে পরি যে, আমার বাইবেল শিক্ষক সত্যিই আমার জন্য চিন্তা করেন। আর তখন থেকে আমি তার উপর ভরসা করতে শুরু করি।” এর কি কোনো ভালো ফলাফল হয়েছিল? অ্যান বলেন, “সেই বিষয়গুলোর উপর আমি মনোযোগ সহকারে চিন্তা করতে শুরু করি, যেগুলো আমি শিখছিলাম।”

আমরা লক্ষ করলাম যে, মণ্ডলীর ভাই-বোনেরা যখন লিসা ও অ্যানের প্রতি ভালো কাজ করেছিল, তখন ভাই-বোনদের সেই কাজ তাদের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। আর এই কারণেই তারা সত্য সম্বন্ধে শিখতে শুরু করেছিল। মণ্ডলীর ভাই-বোনদের কাছ থেকে তারা সত্যিকারের ভালোবাসা পেয়েছিল, আর সেই কারণেই তারা যিহোবা ও তাঁর লোকদের ওপর ভরসা করতে শুরু করেছিল।

যিহোবার মতো অন্যদের প্রতি দয়া দেখান

কোনো কোনো সংস্কৃতিতে নম্রভাবে কথা বলা এবং হাসি মুখে তাকানো একটা সাধারণ বিষয়। আর সেটা প্রশংসার বিষয়। কিন্তু, আমরা যদি শুধুমাত্র আমাদের সংস্কৃতি অথবা আমরা যেভাবে বড়ো হয়ে উঠেছি, তার কারণে লোকদের দয়া দেখিয়ে থাকি, তাহলে আমরা বলতে পারব না যে, আমরা যিহোবার মতো অন্যদের প্রতি দয়া দেখাচ্ছি।—তুলনা করুন, প্রেরিত ২৮:২.

আমরা যদি যিহোবার মতো অন্যদের প্রতি দয়া দেখাতে চাই, তাহলে আমরা পবিত্র শক্তির সাহায্যে তা করতে পারব। (গালা. ৫:২২, ২৩) তাই, এটা বৃদ্ধি করার জন্য আমাদের চিন্তাভাবনা এবং আমাদের কাজকে পবিত্র শক্তির নির্দেশনা অনুযায়ী পরিচালিত করতে হবে। এটা করলে আমরা যিহোবার মতো হতে পারব আর দেখাতে পারব যে, আমরা তাঁকে ভালোবাসি। আমরা যিশুর মতোও হতে চাই আর তাই তাঁর মতো লোকদের জন্য চিন্তা করি ও সেইসঙ্গে তাদের ভালোবাসি। এভাবে যিহোবা ও তাঁর লোকদের প্রতি ভালোবাসাই আমাদের অন্যদের প্রতি দয়া দেখাতে পরিচালিত করে। আর আমরা যখন তা করি, তখন যিহোবা খুবই খুশি হন।

আমরা কাদের প্রতি দয়া দেখাব?

প্রায়ই আমরা সেই ব্যক্তিদের প্রতি দয়া দেখিয়ে থাকি, যারা আমাদের প্রতি দয়া দেখায়। (২ শমূ. ২:৬) আর এই কারণে আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকি। (কল. ৩:১৫) কিন্তু, আমরা যখন মনে করি যে, এই ব্যক্তির প্রতি দয়া দেখানোর প্রয়োজন নেই, তখনও কি আমরা তার প্রতি দয়া দেখাব?

এই বিষয়টা লক্ষ করুন: মহাদয়া দেখানোর ক্ষেত্রে যিহোবা হলেন সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ। আর তাঁর বাক্য থেকে আমরা শিখতে পারি, কীভাবে আমরা অন্যদের প্রতি দয়া দেখাতে পারি। খ্রিস্টীয় গ্রিক শাস্ত্রে “মহাদয়া” শব্দটা বহু বার এসেছে। তাই প্রশ্ন ওঠে, যিহোবা কীভাবে আমাদের প্রতি দয়া দেখিয়ে থাকেন?

যিহোবা পৃথিবীর সমস্ত লোককে জল, বাতাস ও অন্য সবকিছু দিয়ে থাকেন, যার দ্বারা তারা বেঁচে থাকতে পারে। (মথি ৫:৪৫) আসলে, তিনি মানবজাতির প্রতি সেই সময় থেকে দয়া দেখাচ্ছেন, যখন তারা তাঁকে জানতও না। (ইফি. ২:৪, ৫, ৮) যেমন, তিনি মানবজাতির জন্য তাঁর একমাত্র পুত্রকে বলি দিয়েছেন। প্রেরিত পৌল লিখেছিলেন, যিহোবা তাঁর একমাত্র পুত্রকে আমাদের জন্য বলিদান দেওয়ার মাধ্যমে “মহাদয়া” দেখিয়েছেন। (ইফি. ১:৭) এ ছাড়াও, আমরা যদিও বার বার ভুল করি আর যিহোবাকে দুঃখ দিই, তা সত্ত্বেও যিহোবা আমাদের সঠিক পথ দেখান এবং আমাদের ক্রমাগত শেখাতে থাকেন। তাঁর কথা ও নির্দেশনা ঠিক যেন “ঝিরিঝিরি বৃষ্টির” মতো। (দ্বিতীয়. ৩২:২) আমাদের প্রতি যিহোবা যে-মহাদয়া দেখাচ্ছেন, সেই ঋণ আমরা কখনোই শোধ করতে পারব না। সত্যি বলতে কী, যিহোবা যদি আমাদের প্রতি মহাদয়া না দেখাতেন, তা হলে ভবিষ্যতের বিষয়ে আমাদের আর কোনো আশাই থাকত না।—তুলনা করুন, ১ পিতর ১:১৩.

এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, যিহোবা আমাদের প্রতি যে-দয়া দেখিয়েছেন, তা আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে আর সেটাই আমাদের অন্যদের প্রতি দয়া দেখাতে পরিচালিত করে। তাই, অল্প কিছু লোকের প্রতি দয়া দেখানোর পরিবর্তে আমরা যেন প্রত্যেক দিন সকলের প্রতি দয়া দেখাই। (১ থিষল. ৫:১৫) আমরা যখন আমাদের পরিবারের সদস্য, ভাই-বোন, সহকর্মী, সহপাঠী ও প্রতিবেশীদের সঙ্গেও দয়া দেখিয়ে ভালো ব্যবহার করব, তখন তারা সত্যিই ভালো অনুভব করবে। তাদের মনে হবে যেন, প্রচণ্ড শীতের রাতে হাত-পা গরম করার জন্য তারা আগুন পেয়ে গিয়েছে।

আপনার পরিবার অথবা মণ্ডলীতে কি এমন কেউ আছে, যার জন্য আপনি কিছু করতে পারেন অথবা তার সাহস বাড়ানোর জন্য তার সঙ্গে ভালোবেসে কথা বলতে পারেন? হতে পারে, কোনো ভাই অথবা বোনের ঘরবাড়ি পরিষ্কার করা, বাগানের দেখাশোনা করা অথবা কেনাকাটা করার জন্য সাহায্যের প্রয়োজন। এ ছাড়া, প্রচারে গিয়ে আপনার হয়তো এমন একজন ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হল, যার কিছু সাহায্যের প্রয়োজন রয়েছে। আপনি কি তার প্রতি দয়া দেখাবেন?

আসুন, আমরা যিহোবার মতো হই আর নিজেদের কথা ও কাজের মাধ্যমে দেখাই যে, আমরা সবসময় দয়া দেখিয়ে থাকি।

^ কিছু নাম পরিবর্তন করা হয়েছে।